স্বাগতম

শিশু-কিশোরদের জগতে

ক্লাসের পড়া

বয়স ভিত্তিক পড়া

বিজ্ঞান পড়া

যেমন খুশি তেমন পড়া

ইংরেজি শেখা

গন্ধবিহীন স্বর্গীয় ফুল অর্কিড ত্রিপুরা উপজাতির উপকথা

রীতি এবং বিয়ের শর্ত মেনে ধনঞ্জয় শ্বশুর-বাড়িতে চামাকি-কামানি অর্থাৎ জামাই খাটছিল। আসলে ত্রিপুরার উপজাতিদের একাধিক গোষ্ঠির মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত আছে- নবপরিণীত জামাইকে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য শ্বশুরের বাড়িতে বেগার খাটতে হয়। তাকেই বলে জামাই-খাটা বা চামাকি-কামিনি। সময়টা ছিল চৈত্র মাস। আর ওই মাসেই তার জামাই-খাটার মেয়াদ শেষ। তাই ধনঞ্জয় ছিল ফুরফুরে মেজাজে। কারণ, প্রায় এক বছর, এবার সে নিজের গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে গড়িয়ে পূজোর উৎসবে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারবে। বেকার খাটার দিনও শেষ। এবার বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘর বাঁধার সময়।

নির্দিষ্ট দিনে ধনঞ্জয় বউকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাড়ি পৌছাতে হলে তাদের একটি দীর্ঘ বন পেরিয়ে যেতে হয়। তাই দু’জনেরই দ্রুত পা চালিয়ে সন্ধার আগেই জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করল। তারা জঙ্গলের মাঝামাঝি পৌছতেই একটি সুন্দর গন্ধ ভেসে এল তাদের নাকে। প্রায় অপার্থিব সুগন্ধ। জঙ্গলের ভিতরে এত সুন্দর গন্ধ পেয়ে ধনঞ্জয়ের স্ত্রী দাঁড়িয়ে পড়ল। তার দেখা দেখি ধনঞ্জয়ও। স্ত্রী স্বাগত উক্তির মতো বলে উঠল -‘কি মিষ্টি সুগন্ধ!’ সেই সঙ্গেই স্বামীকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ফুলের সুদন্ধ বল তো।’ ধনঞ্জয় তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে উপজাতীয় ভাষায় জানিয়ে দিল‘ এটা খেরেনবাগ বুঝার’ অর্থাৎ এটা এক ধরনের অর্কিড ফুলের সুগন্ধ। ধনঞ্জয়ের স্ত্রী তখন বলে, ‘আমি ওই ফুলের নাম কখনও শুনিনি। দেখিওনি ওই গাছ বা তার ফুল। আর জীবনে কোন দিন এত মিষ্টি গন্ধ আমি শুঁকিনি।’

তারপরে স্বামীর কাছে আবদার, ‘আমার জন্য ওই গাছের একটা ফুল নিয়ে এস। আমি তা মাথায় দোব।’ স্ত্রীর কথা শুনে ধনঞ্জয় জানিয়ে দিল, ‘ওই ফুল তুমি খোঁপায় বাঁধতে পারবে না। কারণ, এটা কোনও সাধারন ফুল নয়। ওটা স্বর্গীয় পুষ্প। ওরা শুধু ঈশ্বরের জন্য ফোটে। মানুষের জন্য ওই ফুল অত্যন্ত বিষাক্ত।’

স্বামীর কথা শুনে ধনঞ্জয়ের স্ত্রী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে- ‘স্বর্গের ফুল কী করে মর্তে এল?’ উত্তরটা জানা ছিল ধনঞ্জয়ের, তাই সে ওই ফুলের মর্তে আগমনের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিল তার স্ত্রীকে। ধনঞ্জয় জানালো-‘পদস্থলনের দায়ে এক অপ্সরীকে স্বর্গ থেকে মর্তে আসতে হয়েছিল। সেই অপ্সরীর প্রিয় ফুল ছিল ওই অর্কিড। অপ্সরীর মর্তে আসার সময় সঙ্গে করে ওই অর্কিড বীজ নিয়ে এসেছিল।’ কিন্তু মর্তের মাটি স্বর্গের মতো অত সুন্দর এবং পবিত্র নয়। তাই এই মাটিতে গাছ হাতে পারে না। তখন আর কী করা, এক বিশেষ পদ্ধতিতে ওই গাছ মর্তে লাগানো হয়। ধনঞ্জয় তার স্ত্রীকে দেখিয়ে দিল, অর্কিডের শেকড় মাটির সঙ্গে যুক্ত নয় কোনও মতেই। সেই সঙ্গেই সে তার স্ত্রীকে জানিয়ে দিল, অর্কিডের শেকড় কী ভাবে একটি গাছের ডালে জড়িয়ে রয়েছে। কী ভাবেই বা গাছটি থেকে অর্কিড শেকড়ের সাহায্যে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করছে। আরো দেখালো সুন্দর অর্কিড ফুলটি, যে ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ধনঞ্জয়ের স্ত্রী ফুলটি সংগ্রহ করে সেটি নিজের খোঁপায় বাঁধতে চেয়েছিল।

ধনঞ্জয়ের স্ত্রী তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল, এত সুন্দর একটি ফুল কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে? ধরঞ্জয় উত্তরে তার স্ত্রীকে বলল, সে তার গ্রামের একটি ডেয়ারি লোকদের কাছে শুনেছে, কোনও পুরুষ বা মহিলা যদি ওই স্বর্গীয় ফুল খোঁপায় গোঁজে তা হলে সে বানর জাতীয় পশুতে পরিনত হয়ে যাবে।

কিন্তু ধনঞ্জয়ের কথা বিশ্বাস করতে পারল না তার স্ত্রী। সে একাগ্র চিত্তে অবাক হয়ে অর্কিড ফুলটির দিকে তাকিয়ে থাকল। স্ত্রীর অবস্থা দেখে ধনঞ্জয় বুঝতে পারল, তার কথায় তার স্ত্রী দুঃখ পেয়েছে। তাই সে তার স্ত্রীকে বলল, ‘দুঃখ পেয়ো না। আমি তোমাকে অর্কিডের ফুল তুলে দোব। তবে সাবধান, ভুলেও ওই ফুল খোঁপায় গুঁজো না। তুমি খোঁপায় গুঁজলেই আমি বানরে পরিনত হয়ে যাব। এক কাজ করো, ‘আমি ফুল পেড়ে দিচ্ছি। তুমি সেগুলি জড়ো করে রাখ। গ্রামে ফিরে ওই ডেয়ারির লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব।’

ওই কথা বলে, বিষাদগ্রস্থ স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে যে গাছে অর্কিড গাছটি জড়িয়ে ছিল ধনঞ্জয় সেই গাছে উঠে অর্কিডের ফুল পেড়ে ছুঁড়তে লাগল তার স্ত্রীর দিকে। ফুলের সৌন্দর্য আর মধুর গন্ধে মাতোয়ারা ধনঞ্জয়ের স্ত্রী প্রথম ফুলটি হাতে পেতেই আনমনে গুঁজে দিল নিজের খোঁপায়। তখন তার কন্ঠে নেমে এসেছে গুন গুন সুরে গান। হঠাৎ, গাছ থেকেই ধনঞ্জয় চিৎকার করে তার স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল,‘তুমি কী ফুল খোঁপায় গুঁজেছ? দেখ আমার হাতটা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে গাছে।’ স্বামীর কথা কানে যেতেই সংবিৎ ফিরে পেল ধনঞ্জয়ের স্ত্রী। তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

তখনও ধনঞ্জয় চীৎকার করে বলে চলেছে, ‘তুমি নিশ্চয় তোমার খোঁপায় খেরেনবার ফুল গুঁজেছ। আমি বুঝতে পারছি কত দ্রুত আমার শরীরটা বদলে যাচ্ছে।’

ধনঞ্জয়ের স্ত্রী অতি দ্রুত মাথা থেকে খেরেনবার ফুলটি তুলে মাটিতে ছুঁড়ে দিল। তার পরেই গাছের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। কী অদ্ভুত ভাবে তার স্বামীর দেহটা মানুষ থেকে বানরের মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে। স্বামীর এই দৈহিক পরিবর্তন দেখে সে ভীত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাছের উপরেই ধনঞ্জয় সম্পূর্ণভাবে বানর জাতীয় প্রাণীতে পরিনত হয়ে গলে। তার তাই দেখে ধনঞ্জয়ের স্ত্রী পরিত্রাহি চিৎকার করে ধনঞ্জয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘বল কী করলে তুমি আবার মানুষে পরিণত হবে। আমি তাই করব। বল। বল। আমাকে কী করতে হবে।’

গাছ থেকে বানরে পরিনত হয়ে যাওয়া ধনঞ্জয় তার স্ত্রীকে বলল-‘আমি আর কোন দিনই মানুষ হতে পারব না। এখন জঙ্গলের অন্য বানর জাতীয় প্রাণীর সঙ্গে আমাকে বসবাস করতে হবে। বরং তুমি খুব দ্রুত পা চালিয়ে গ্রামের দিকে চলে যাও। যাতে আঁধার নামার আগেই তুমি সেখানে পৌছে যেতে পার। সেখানে গিয়ে তুমি বরং আমার মা বাবার সঙ্গে বসবাস কর। এ জীবনে আর আমাদের দেখা হবে না। অপেক্ষা করবে। হয়তো পরের জন্মে আমাদের মিলন হবে।’

নিজের ভুলে বা জেদের বশে স্বামীর ওই অবস্থা হওয়ায় ধনঞ্জয়ের স্ত্রী অত্যন্ত দুঃখ পেল। সেই সঙ্গেই স্বামীর কাতর কথাবার্তা তাকে কুরে কুরে খেতে শুরু করল। সে তার বানর হয়ে যাওয়া স্বামীকে লক্ষ করে বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গেই সুখে বাঁচতে চাই। কিন্তু ঈশ্বরের সেই সুখ সইল না। এখন কার জন্য আমার ঘরে ফেরা? তার চেয়ে আমি বরং এখানেই তোমার চোখের সামনেই মরব।’ এই বলেই ধনঞ্জয়ের স্ত্রী ওই গাছের গুঁড়িতেই নিজের মাথা ঠুকতে লাগল।

মাথা ফেটে প্রচন্ড রক্তপাত হতে লাগল।শেস পর্যন্ত সেখানেই তার মৃত্যু হল। সমস্ত ঘটনা চোখের সামনে দেখেও বানরে পরিনত হয়ে যাওয়া ধনঞ্জয় স্ত্রীকে বাঁচাতে কিছুই করতে পারল না। শুধু গাছের ডালে বসে ‘হু হু হুলক হুটা’ শব্দ করতে লাগল।

পরে বার জন্ম হল ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর। কিন্তু খেরেনবার ফুলের প্রতি তার ভীষণ আসক্তির জন্যই সে কিছুতেই বানর প্রজাতির জীব হতে পারল না।

আসলে ধনঞ্জয় আর তার স্ত্রীর কান্ডকারখানায় ঈশ্বর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যদি ওই ফুলের সুগন্ধ থেকে যায় তা হলে ধনঞ্জয়ের মতোই পরিনতি হতে পারে অনেক দম্পতির। ওই ঘটনার পরেও প্রতি বসন্তেই অর্কিডের ফুল ফোটে পৃথিবীতে কিন্তু অর্কিড ফুল থেকে ঈশ্বর সুগন্ধ কেড়ে নিয়েছেন।

Share this:

ABOUTME

শিশু কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে এটাই আমার কর্তব্য। আর এই কর্তব্যজ্ঞান থেকেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষা শিশুদের অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য ইন্টারনেট ছাড়া কোন পথ নেই। আমি চেষ্টা করেছি শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য একটি উন্নত অনলাইন ভিত্তিক তথ্যভান্ডরের অবকাঠামো তৈরী করার। যদি আমার এই প্রচেষ্টা থেকে বাংলাদেশের একটি শিশুও উপকৃত হয় তবে আমার কর্ম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব।

JOIN CONVERSATION

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment