ততদিনে ছেলের লেখাপড়া শিখিবার বয়স হইয়াছে। পাউন্ডস নিজেই তাহাকে শিক্ষা দিবার আয়োজন করিতে লাগিল। তাহার প্রথম ভাবনা হইল যে, একা একা লেখাপড়া শিখিলে শিশুর মনে হয়তো ফুর্তি আসিবে না, তাহার দু-একজন সঙ্গী দরকার। এই ভাবিয়া সে পাড়ার দু-একটি ছেলেমেয়েকে আনিয়া তাহার ক্লাসে ভর্তি করিয়া দিল। দুটি একটি হইতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেখিতে দেখিতে পাঁচ সাতটি হইয়া উঠিল। কিন্তু তাহাতেও খোঁড়া মুচির মন উঠিল না— সে ভাবিতে লাগিল, 'আহা, ইহারা কেমন আনন্দে উৎসাহে লেখাপড়া শিখিতেছে; কিন্তু এই সহরের মধ্যে এমন কতশত শিশু আছে, যাহাদের কথা কেহ ভাবিয়াও দেখে না।' তখন সে আরও ছাত্র আনিয়া তাহার ছোট্ট ক্লাসটিকে একটি রীতিমত পাঠশালা করিয়া তুলিল।
যেদিন তাহার একটু অবসর জুটিত, সেইদিনই দেখা যাইত জন পাউন্ডস খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে রাস্তায় রাস্তায় ছেলে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। যত রাজ্যের অসহায় শিশু, যাদের বাপ নাই, মা নাই, যত্ন করিবার কেহ নাই, তাহাদের ধরিয়া ধরিয়া সে তাহার পাঠশালায় ভর্তি করিত। ছেলে ধরিবার জন্য তাহার প্রধান অস্ত্র ছিল আলুভাজা! প্রথমে এই আলুভাজা খাওয়াইয়া পাউন্ডস রাস্তার শিশুদের ভুলাইয়া আনিত। আলুভাজার লোভে তাহারা পাঠশালায় আসিত, কিন্তু যে আসিত সে আর ফিরিত না। মাস্টারমহাশয়ের কি যে আকর্ষণশক্তি ছিল, আর ঐ অন্ধকার পাঠশালার মধ্যে কি যে মধু ছেলেরা পাইত, তাহা কেহই বুঝিত না; কিন্তু ছাত্রের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিল।
চার হাত চওড়া, বারো হাত লম্বা, সরু বারান্দার মতো ঘর; তাহার মাঝখানে বাসিয়া মাস্টারমহাশয় জুতা সেলাই করিতেছেন আর পড়া বলিয়া দিতেছেন, আর চারিদিকে প্রায় চল্লিশটি ছাত্রের কোলাহল শুনা যাইতেছে। কেহ পড়িতেছে, কেহ লিখিতেছে, কেহ অঙ্ক বুঝাইয়া লইতেছে। কেহ সিঁড়ির উপর, কেহ মেঝের উপর, কেহ চৌকিতে, কেহ বাক্সে— আর নিতান্ত ছোটদের কেহ কেহ হয়তো মাস্টারের কোলে— এইরকম করিয়া মহা উৎসাহে লেখাপড়া চলিতেছে। বাহিরের লোক ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া অবাক হইয়া এই দৃশ্য দেখিত।
গরীব মাস্টার ছাত্রদের কাছে এক পয়সাও বেতন লইত না— এতগুলি ছাত্রকে সে বই জোগাইবে কোথা হইতে? তাহাকে সহরে ঘুরিয়া পুরানো পুঁথি ছেঁড়া বিজ্ঞাপন প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে হইত, এবং তাহাতেই ছেলেদের পড়ার কাজ কোনরকমে চলিয়া যাইত। কয়েকখানা স্লেট ছিল, তাহাতেই সকলে পালা করিয়া লিখিত। পাঠশালায় সামান্য যোগ বিয়োগ হইতে ত্রৈরাশিক পর্যন্ত শিখান হইত। কেবল তাহাই নয়, এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা তাহার কাছে কাপড় সেলাই করিতে এবং জুতা মেরামত করিতেও শিখিত। সকলে মিলিয়া তীর ধনুক ব্যাট বল ঘুড়ি লাটাই খেলনা পুতুল প্রভৃতি নানারকম জিনিস নিজেরাই তৈয়ারি করিত। তাহাদের খাওয়া-পরার সমস্ত অভাবের কথাও গরীব মাস্টারকেই ভাবিতে হইত। এই সমস্ত দেখিয়া-শুনিয়া জন পাউন্ডসের উপর কোন কোন লোকের শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। তাহারা মাঝে মাঝে গরম কাপড়-চোপড় পাঠাইয়া দিত। সেইসব কাপড় পরিয়া ছেলেমেয়েরা যখন উৎসাহে খোঁড়া মাস্টারের সঙ্গে বেড়াইতে বাহির হইত, তখন মাস্টারমহাশয়ের মুখে আনন্দ আর ধরিত না।
এমনি করিয়া কত বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল, জন পাউন্ডস বুড়া হইয়া পড়িল, কিন্তু তাহার পাঠশালা চলিতে লাগিল। আগে যাহারা ছাত্র ছিল, তাহারা ততদিনে বড় হইয়া উঠিয়াছে। কতজনে নাবিক হইয়া কত দেশ-বিদেশ ঘুরিতেছে, কতজনে সৈন্যদলে ঢুকিয়া যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতেছে। নূতন ছাত্রদের পড়াইবার সময়ে এইসব অতি পুরাতন ছাত্ররা তাদের বৃদ্ধ গুরুকে দেখিবার জন্য পাঠশালায় হাজির হইত। তাহারই ছাত্রেরা সে সৎপথে থাকিয়া উপার্জন করিয়া খাইতেছে, এবং এখনও যে তাহারা তাহাদের খোঁড়া মাস্টারকে ভোলে নাই, এই ভাবিয়া গৌরব আনন্দে বৃদ্ধের দুই চক্ষু দিয়া দরদর করিয়া জল পড়িত।
১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে নববর্ষের দিনে ৭২ বৎসর বয়সে পাঠশালার কাজ করিতে করিতে বৃদ্ধ হঠাৎ শুইয়া পড়িল। বন্ধুবান্ধব উঠাইতে গিয়া দেখিল, তাঁহার প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। হয়ত তখনও লোকে ভাল করিয়া বোঝে নাই যে কত বড় মহাপুরুষ চলিয়া গেলেন। তাহার পর প্রায় আশি বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এখন ইংলন্ডের সহরে সহরে অসহায় গরীব শিশুদের শিক্ষার জন্য কত ব্যবস্থা, কত আয়োজন; কিন্তু এ সমস্তের মূলে ঐ খোঁড়া মুচির পাঠশালা। সেই পাঠশালায় যাহারা পড়িতে আসিত, কেবল তাহারাই যে জন পাউন্ডসের ছাত্র তাহা নয়— যাঁহারা নিজেদের অর্থ দিয়া, দেহের শক্তি দিয়া, একাগ্র মন দিয়া, অসহায় গরীব শিশুদের শিক্ষা ও উন্নতির চেষ্টা করিতেছেন তাঁহারা অনেকেই গৌরবের সঙ্গে এই খোঁড়া মুচিকে স্মরণ করিয়া বলিতেছেন, "আমরাও আচার্য জন পাউন্ডসের শিষ্য।"
এই খোঁড়া মুচির নাম সকলের কাছে স্মরণীয় রাখিবার জন্য, তাঁহার ভক্তেরা মিলিয়া তাঁহার একটি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।
ABOUTME
শিশু কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে এটাই আমার কর্তব্য। আর এই কর্তব্যজ্ঞান থেকেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষা শিশুদের অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য ইন্টারনেট ছাড়া কোন পথ নেই। আমি চেষ্টা করেছি শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য একটি উন্নত অনলাইন ভিত্তিক তথ্যভান্ডরের অবকাঠামো তৈরী করার। যদি আমার এই প্রচেষ্টা থেকে বাংলাদেশের একটি শিশুও উপকৃত হয় তবে আমার কর্ম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
0 comments:
Post a Comment